এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
‘‘Justice Hurried Justice Buried’–এ প্রবাদ বাক্যটির সাথে আপনারা নিশ্চয়ই কম-বেশী পরিচিত। কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলায় এক মাদ্রাসাছাত্রীকে ধর্ষণ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের মাত্র তিন কার্যদিবসে আসামির যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ দিয়েছেন। রায় ঘোষণার দিক থেকে দেশের ইতিহাসে এটিই দ্রুততম বলে অনেকে বাহবা নিচ্ছেন। ৭ দিনে তদন্ত শেষে পুলিশ ১৩ অক্টোবর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ১২ নভেম্বর আদালত আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। ১৩ ও ১৪ নভেম্বর সরকারি ছুটি থাকায় আদালত বন্ধ ছিল। ১৫ নভেম্বর বাদীসহ ১৩ জন আদালতে সাক্ষ্য দেন।
১৭ নভেম্বর সকাল থেকে আদালতে মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপিত হয়। যুক্তিতর্ক শেষে আদালত দুপুরের পর রায় ঘোষণার সময় নির্ধারণ করেন। এরপর বেলা ১টা ১২ মিনিটে আদালতের বিচারক আসামির উপস্থিতিতে রায় ঘোষণা করেন।
২০০৭ সালে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের ফৌজদারি বিধির কন্টেম্পট পিটিশন নং ৯৫৭১/২০০৭ (রাষ্ট্র বনাম আদালত অবমাননাকারী) মামলায় স্বয়ং মহামান্য বিচারপতি আদালত অবমাননা সম্পর্কে রায় প্রদান করতে গিয়ে বলেছেন, বিচারকরা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয় তবে সে সমালোচনা সংযত ও বস্তুনিষ্ঠ হওয়া দরকার। একজন বিচারকের রায় নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা করতে আইনগত কোনো প্রকারের বাঁধা নেই। কিন্তু প্রদত্ত সে রায়ের কারণে বিচারককে ব্যক্তিগতভাবে সমালোচনা করা যাবে না। বিচারকদের দায়িত্ব কোনো মামুলি দায়িত্ব নয় বরং গুরু দায়িত্ব। বিচারকের কাজের সঙ্গে চিকিৎসকের কাজের তুলনা করলে ভুল হবে না। প্রতিটি চিকিৎসক জীবন্ত মানুষের হৃদয়ে, মস্তকে বা শরীরের অন্যান্য বিশেষ অপরিহার্য ও সংবেদনশীল অঙ্গে অপারেশন করার সময় তার সম্পূর্ণ মনোযোগ শুধু অপারেশনে নিয়োজিত করে থাকেন। কেননা তিনি জানেন তার মনোযোগের সমান্যতম বিঘœ ঘটলে রোগীর প্রাণহানি ঘটতে পারে। যদি কোনো কারণে সে চিকিৎসক সমালোচনার সম্মুখীন হন কিংবা ভীত হয়ে যান তবে তার পক্ষে যেমন অপারেশন করা দুরূহ হয়ে পড়বে ঠিক তেমনি বিজ্ঞ বিচারকরা যদি সমালোচনার ভয়ে ভীত হয়ে পড়েন তবে তা হলে বিচারকার্য অবিচারে পর্যবসিত হতে পারে। ফলাফল হিসেবে বিচারক সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সুদূর প্রসারিভাবে রাষ্ট্রের আপামর জনসাধারণ অপরিসীম ক্ষতির স্বীকার হতে পারেন।
কাজেই মন্তব্য, সমালোচনা, তদন্ত ও গ্রহণের যুগে বিচার বিভাগ যৌক্তিক ও অনিষ্টবিহীন সমালোচনার হাত থেকে নিরঙ্কুশভাবে অব্যাহতি দাবি করতে পারে না। আদালতের বিরুদ্ধে সমালোচনা করা হলে তাঁকে তা মেনে নিতে হবে। (৪৪ ডিএলআর, এডি, ১৯৯২, ৩০]। কিন্তু সমালোচনাটি শোভন ভাষায় নিরপেক্ষ, অনুভূতিপূর্ণ, সঠিক ও যথাযথ হতে হবে। সম্পূর্ণভাবে যেখানে সমালোচনার ভিত্তি হচ্ছে সত্যবিকৃতি ও পুরো বানোয়াট এবং বিচারকের ন্যায়পরায়ণতার ওপর কটাক্ষপূর্ণ ও বিচার বিভাগের সম্মান খাটো করা ও জনগণের আস্থা ধ্বংস করে দেয়া এটা উপেক্ষা করা যায় না। যেহেতু আইনের মহার্ঘতা অবমাননাকারীদের দ্বারা কালিমা লিপ্ত করার অনুমতি দেয়া যায় না।
রাষ্ট্র চাইলে দ্রুত যে কোনো মামলার নিষ্পত্তি করতে পারে। তাহলে লক্ষ লক্ষ মামলা পেন্ডিং কেন? যদিও রাজনৈতিক হত্যার বিচার এর ব্যতিক্রম। আবার জটিল হত্যা মামলায় এত দ্রুত বিচার করতে গেলে ন্যায়বিচার ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে। এ জন্য দরকার আসলে পরিমিতিবোধের।
বাংলাদেশের হাজার হাজার আলোচিত মামলায় আসামিপক্ষ জেরা ও যুক্তিতর্কের জন্য কেমন সময় পেয়েছে জানি না। তবে রাজনৈতিক মামলার বিচার কেন তাড়াতাড়ি শেষ হয় না আর রাজনৈতিক এ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের এই পীড়িত হালে মামলার বিচারের গতি কী ধরনের বিষয়ের ওপর নির্ভর করে তা সবাই জানেন। আমাদের আইন-আদালতের স্বাধীনতা কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে নেই। আর সে কারণে ওই সব মামলার বিচারের বিষয় এ আলোচনায় আনব না।
মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট যখন মানুষের পকেটে ছিল না, ছিল না যখন স্যাটেলাইট টেলিভিশন, সামাজিক মাধ্যম ফেইসবুক সেই সময়কার দৈনিক পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত প্রচারিত আলোচিত অনেকগুলো হত্যা মামলা পঁচিশ, ত্রিশ, এমনকি চল্লিশ বছরেও বিচারে নিষ্পত্তি হয়নি।
গুরু বাক্য বলে, ফুল থেকে মৌমাছি নেয় মধু আর মাকড়শা নেয় বিষ। সংস্কার নয়, আমাদের বাঙালি মূল্যবোধে যে সব আচার-বিচার বেমানান, আমাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য
তৈরি করতে পারে না এমন সকল বিষয় আমাদের আরও মাতাল করে তুলেছে। ভয়ঙ্কর রকম বিকৃতি আর উন্মাদ ব্যবস্থার গর্তে আমরা আটকে পড়েছি। সেই সঙ্গে ধর্ম পড়েছে মধ্যযুগের কূপম-ূক, বর্বরদের হাতে। এ গভীর অন্ধকার থেকে উদ্ধার করার মতো সামাজিক নৈয়ায়িক শক্তির বিকাশ অথবা বোধন নেই। আকাশ-সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তির নঞর্থক পড়ছে সমাজ ও পরিবারে। তা বলে তো প্রযুক্তিকে পর্দা দিয়ে আড়ালে রাখা যাবে না।
২০০২ সালে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন প্রণয়নের পর দেশের চারটি বিভাগীয় নগরে স্পর্শকাতর, জনগুরুত্বসম্পন্ন মামলার বিচারের জন্য দ্রুত বিচার শুরু হয়। এ আইনে ১৩৫ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার শেষ করার বিধান রয়েছে। এ সময়ে বিচার শেষ করতে না পারলে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একটি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক যদি মনে করেন তবে যতদিন এর অধীনে মামলার বিচার শেষ না হবে ততদিন তিনি বিচার চালিয়ে যেতে পারবেন। ২০০৮ সালে এ সিদ্ধান্ত এসেছিল আপিল বিভাগের কাছ থেকে।
বিদ্যমান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধিত ২০০৩ অনুযায়ী ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনার বিচার শেষ করার বিধান রয়েছে। যদি এ মেয়াদে শেষ না করা যায় তবে রাষ্ট্রপক্ষকে (প্রসিকিউশন পক্ষ) এ সময়ের মধ্যে বিচার শেষ না করার উপযুক্ত কারণ উচ্চ আদালতকে ব্যাখ্যা করে বিচারের সময় বাড়িয়ে আনতে হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, খুব কম ক্ষেত্রেই এ নিয়ম মানা হয়।
আমাদের দেশে বিদ্যমান ফৌজদারি কার্যবিধির ২৬৫ জি (২) ধারায় বলা হয়েছে, আদালত তার ইচ্ছাধীন ক্ষমতাবলে কোনো সাক্ষীর জেরা অন্যান্য সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্থগিত রাখতে পারবেন। অথবা কোনো সাক্ষীকে আরও জেরা করার জন্য পুনরায় ডাকতে পারবেন। এ বিধান অনুযায়ী কিন্তু দ্রুত একনাগাড়ে সাক্ষ্য নেওয়ার অবারিত সুযোগ বিচারককে দেওয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষ, আসামিপক্ষ ও বিচারক, সবাই মনে করলে কম সময়ের মধ্যেই হত্যাসহ যে কোনো ফৌজদারি অপরাধের বিচার শেষ করতে পারে। বিষয়টি নিয়ে দেশের আইন জগতের অনেক কৃতী মানুষ অনেক কথা বলেন। কিন্তু আইনের বিষয়গুলো নিয়ে বলেন না। পর্যাপ্ত আইন আগে থেকেই রয়েছে। যেটা নেই সেটি হচ্ছে আইনের অ-প্রয়োগ। আর অনেক বিচারকেরই বিচারিক মনোভাব ও মনোজগতে প্রগতির পক্ষের সাংস্কৃতিক চেতনার অভাব রয়েছে। রয়েছে দুর্নীতির সমস্যাও।
যে কোনো ফৌজদারি মামলারই বিচারকালীন পর্যায়ে যে বিষয়টি আমাদের বিচারালয়ে উপেক্ষিত থাকে তার প্রধানতম হল, সাক্ষীদের সুরক্ষা দেওয়া। অনেক সময় সাক্ষীদের সঙ্গে দুব্যর্বহারও করা হয়। রয়েছে সাক্ষীদের রাহা-খরচ প্রদানের সঙ্কট; সাক্ষীদের আদালতে হাজির হওয়ার জন্য পুলিশের জবাবদিহির অভাব; রিভিশন মামলার নথি ব্যবহারের জন্য নেওয়া নিম্ন আদালতের নথি শুনানি শেষে তা আবার নিম্ন আদালতে তাড়াতাড়ি ফেরত পাঠানো; আসামিপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের তাদের সাক্ষীদের প্রস্তুত না করে ফিরিয়ে দেওয়া।
সবার উপরে রয়েছে বিচারে হস্তক্ষেপ। সবাই দেখছে রাজা উলঙ্গ। তবু কেউ বলছে, রাজা তো মিহি মসৃণ কাপড় পরা, তাই খালি চোখে তা ধরা পড়ছে না। তিনদিনে বিচারিক হত্যাকান্ড আর বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের মধ্যে পার্থক্য কিছু দেখছি না। যে দেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকে অনেকে সমর্থন করেন, এটার পক্ষে হাওয়া দেন, আর আম জনতা বুঝে না বুঝে সেটার সমর্থন করেন। সে দেশে তিন দিনেই আমৃত্যু কারাদন্ডের আদেশে বাহবা পাওয়া, নেয়া, দেওয়া অযৌক্তিক কিছু না। আাসুন, গোটা সমাজ এবং রাষ্ট্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয় সে সব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে মনোযোগী হয়ে বাহবা নিই।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। মোবাইলঃ ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮, ইমেইলঃ seraj.pramanik@gmail.com